সংগ্রাম দত্ত:
শ্রী শ্রী আদিনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের নামনুসারে। বাংলাদেশের দক্ষিন প্রান্তে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর ঘেষা মৈনাক পর্বতের সর্বউচ্চ চূড়ায় মনোরম পরিবেশে আদিনাথ শিব, তীর্থ মন্দিরটির অবস্থান। আদিনাথের অপর নাম মহেশ। এই মহেশের নাম অনুসারে মহেশখালী। আদিনাথের গোড়াপত্তন কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে ত্রেতাযুগে, এর একটি ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে এবং তা পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ, রামায়ণ, পুরাণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়। তিনি সর্ব গুনময় হয়েও গুণাতীত অব্যক্ত ভগবান। ব্যক্ত চরাচরে শিবরূপি ঊর্ধ্বরুপি শিবলিঙ্গ। সকলি নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত রেখে জ্ঞানময়, কল্যাণময় মঙ্গলময় সর্বকল্যুষ বিনায়ক, সত্য শ্বাশত সনাতন।
সাগর পাড়ের পাহাড় ঘেষা নির্জন মনোমুগ্ধকর স্থানে শ্রীশ্রী আদিনাথের গোড়াপত্তন। প্রকাশ মন্দির নির্মাণ। তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত লাভের ইতিহাস ব্যাপক। তবে সংক্ষিপ্ত আকারে এই সব ইতিহাস এখানে আলোচিত হয়েছে।
শ্রীশ্রী আদিনাথ সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায়ের বৃহৎ তীর্থস্থান। যে কোন সনাতনী ব্যক্তি শ্রীশ্রী আদিনাথ
দর্শন না করে অন্য তীর্থ কখনও সফলকাম হয় না। যেহেতু স্বয়ং মহাদেব একমাত্র এই স্থানেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। সুতরাং তীর্থের মোক্ষ্য লাভের এবং মনসকামনা পূরনের জন্য শ্রীশ্রী আদিনাথ দর্শনই সর্বশ্রেষ্ঠ।
ত্রেতা যুগের রাম রাবণের যুদ্ধের কথা। রাবণ লঙ্কা যুদ্ধে রামের সঙ্গে জয় লাভের জন্য উদগ্রীব। তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অমরত্ব বর প্রার্থনা করেন। এই সময়ে মহাদেব কৈলাশে ধ্যানমগ্ন। রাবনের আরাধনায় দেবাদিদেব সন্তুষ্ট হয়ে রাবণকে বর দিলেন। তবে সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলেন। শর্ত হল শিবরূপি উর্ধ্বমুখী শিবলিঙ্গকে কৈলাশ থেকে বহন করে লঙ্কায় নিয়ে যেতে হবে, পথিমধ্যে কোথাও রাখা চলবে না। যদি পথিমধ্যে কোথাও রাখা হয় তাহা হলে মহাদেব সেই স্থানেই অবস্থান নিবেন। রাবণ শর্ত মেনে নিয়ে মহাদেবকে কাঁধে করে নিয়ে রওয়ানা হলেন। যাত্রাপথে এই মৈনাক শিখরে রাখতে বাধ্য হন। ঐ সময় এই স্থানে নারায়ণ ব্রাহ্মণ রুপে আবির্ভূত হলেন। রাবণ এই ব্রাহ্মণকে স্বাক্ষী স্বরূপ দাঁড় করিয়ে এই পর্বতের পিছনে প্রকৃতির কাজ সারতে গেলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ রূপে নারায়ণ কালক্ষেপণ না করার জন্য সময় বেধে দিলেন। রাবণ প্রকৃতির কাজ কয়েক ঘন্টা শেষ করতে পারলেন না, ঐ জায়গাটি এখনো বিদ্যামান, যাহার নাম মুদিরছড়া রূপে পরিচিতি বহন করছে, মন্দিরের এক কিলোমিটার পিছনে। প্রকৃতির কাজ সেরে রাবণ এসে সেই ব্রাহ্মণ দেখতে পেলেন না। অবশেষে শিলারূপি মহাদেবকে কাঁধে উঠাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন অবস্থাতে উঠাইতে পারলেন না। শেষে ক্রোধান্বিত হয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও উঠাতে পারলেন না। উঠানোর চেষ্টার চিহ্ন হিসেবে এই পাথরের উপর একটি চাপ পড়ে। যা এখনো বিদ্যামান। শেষে দৈববাণী হতে লাগল রাবণ তোমার অমরত্ব লাভ ব্যর্থ হল, তুমি খালি হাতে লঙ্কায় চলে যাও। মহাদেব এই মৈনাক শিকরেই অবস্থান নিবেন। রাবণ যেই লঙ্কায় পৌঁছলেন তখন রামের সাথে ভয়ংকর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজয় বরণ করলেন।
এই দিকে শ্রীশ্রী আদিনাথের মৈনাকে অবস্থান নেওয়া এবং আবিষ্কার সম্পর্কে এক সুন্দর জনশ্রুতি আছে। জনশ্রুতি হলেও এলাকাবাসীদের মতে ঘটনাটি সত্য। এই সত্য আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। তা হল সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায়ের এই তীর্থ স্থানটি আবিস্কৃত হয় ও বিশেষ মর্যদা পায় এই মহেশখালীর একজন সচ্ছল মুসলিমের হাতে। তাঁর নাম নূর মোহাম্মদর সিকদার। তাঁর একটি গাভী হঠাৎ দুধ দেওয়া বন্ধ করিয়া দেয়। এই ব্যাপারে তিনি রাখাল ছেলের উপর সন্ধিহান হন এবং প্রতিদিন রাখাল ছেলেকে গালমন্দ দিতে থাকেন। মনিবের গালমন্দে অতিষ্ঠ্য হয়ে রাখাল ছেলেটি রাত্রি বেলায় গোয়াল ঘরের গাভীটিকে পাহারা দেওয়া আরম্ভ করলেন। কারন কেউ দুধ চুরি করেন কিনা। গভীর রাত্রে সে দেখতে পায় গাভীটি গোয়াল ঘর থেকে বের হয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছে। এই দিকে রাখাল বালক ও গাভীটির পিছনে অনুসরণ করতে থাকে। গাভীটি সোজা চলে এসে ঐ কাল পাথরের উপর গিয়ে দাঁড়ায় এবং আপনা আপনি ঐ পাথরের উপর দুধ পড়তে থাকে। দুধ পড়া শেষ সঙ্গে সঙ্গে গাভীটি পূনরায় ঐ নূর মোহাম্মদ সিকদারের গোয়াল ঘরে চলে ফিরে যায়। এই অবস্থা রাখাল বালকটি স্বচক্ষে দেখে তাঁর মালিককে পূর্ন ঘটনা খুলে বলে। কিন্তু গৃহকর্তা তেমন গুরত্ব না দিয়ে গাভীটিকে বড় মহেশখালী নামক স্থানে সরিয়ে রাখলেন।
এই সময় তিনি রাত্রিতে স্বপ্নে দেখেন যে, গাভীটিকে দূরে লোহার শিকলে বেঁধে রাখলেও ঐ স্থানে দুধ দেওয়া বন্ধ হবে না বরং গাভীটির আসা-যাওয়া কষ্ট হবে। তিনি আরো স্বপ্নে আদেশ পান ঐ স্থানে মন্দির বেঁধে দেওয়ার স্থানীয় হিন্দু জমিদারকে বলার জন্য। ইতি মধ্যে সেই রাখাল ছেলেটি ঐ কালপাথরে একখানা ছোরা দিয়ে শান দিতে থাকায় তখনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে তাকে উদ্ধার করা হলেও আর বাঁচানো যায়নি।
আবার এই নূর মোহাম্মদ সিকদারই শিবের শক্তি অষ্টভুজাকে সুদূর নেপাল থেকে এনে এই মৈনাক শিকরে প্রতিষ্ঠা করার আদেশ পান এবং নাগা সন্ন্যাসীর মাধ্যমে ১৬১২ সালে নেপাল ষ্টেইটের মন্দির থেকে চুরি করে নিয়ে আসার সময় ধরা পড়ে যায় ও জেল বন্দি হয়ে পড়েন। যেদিন রায় ঘোষনা হবে তার পূর্ব রাত্রিতে এই নাগা সন্ন্যাসী যোগমায়া বলে মহাদেবের সান্নিধ্যে কৃপা লাভ করেন এবং মহাদেব অভয় বানী দেন। বিচারক তোমাকে যে প্রশ্ন করুক না কেন তুমি নির্ভয়ে তোমার মুখ দিয়ে যা বের হবে তাহাই বলবে। পর দিন তাই হলো।
মহামান্য বিচারক নেপাল রাজাকে প্রশ্ন করে মুর্তি রং জানতে চান। রাজা উত্তরে উনার মুর্তির রং কষ্টি পাথরের বর্ণনা দেন ।আবার ঐ নাগা সন্ন্যাসী উত্তরে বলেন আমার মুর্তির রং সাদা। এখন মহামান্য বিচারক প্রত্যেকের সম্মুখে উম্মোচন করে দেখেন প্রকৃত সাদা রং-ই মুর্তির আসল রং। তখনই নাগ সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় ঘোষনা করা হয় এবং নেপালের রাজা ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রকৃত ঘটনা জানতে উদ্গ্রীব হন। তখন নাগা সন্ন্যাসী বিস্তারিত খুলে বলেন। এতে ঐ রাজাই এই মুর্তিটিকে যথাযথ মর্যাদার সাথে এই মৈনাক পর্বতে শ্রীশ্রী আদিনাথের পার্শ্বেই স্থাপিত করে এবং মূল মন্দির নির্মাণ করে যান। এখনো প্রায় সময় নেপাল সরকার মাঝে মধ্যে যথাসাধ্য অনুদান দিয়ে থাকেন। এই মৈনাক পর্বত হিমালয়ের শাখা, পুরাকালে প্রাগইতিহাস্পুর, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, আরকান, ব্রহ্মদেশ, মালদ্বীপ ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপুপঞ্জ পর্যন্ত এক সমসূত্রে গাঁথা ছিল। বর্তমান সময়ের নিম্নবঙ্গ ছিল সাগর গর্ভে, অর্য্যরা এই অঞ্চলকে পূর্ব সাগর বলত। অর্থাৎ মগদের পরই ছিল সমুদ্র। এমনকি বিন্দ পর্বত ও দক্ষিণ সাগর তীরবর্তী বলে উল্লেখ আছে,। এই মৈনাকের অবস্থান লবণ সমুদ্রে, পূরান আদিতে উল্লেখ আছে। চট্টগ্রাম দক্ষিন পশ্চিম দিকস্থ মহেশখালী দ্বীপ। এই দ্বীপেই মৈনাক, মৈনাক শীর্ষেই আদিনাথ শিবের অবস্থান।
কথিত আছে, নেপালের রাজা নস্মসিষ স্বপ্নে দেবতার আদেশে উপমহাদেশের পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এগুলো হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভূতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ আর সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ।
তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁন দেওয়ান ব্রজ কিশোর লাল কানুনগোর প্রতিনিধি দেওয়ান কালিচরণের নয় বৎসরের কিশোর শরৎ চন্দ্র কে সঙ্গে নিয়ে এই দ্বীপে আসেন এবং দ্বীপটি ক্রয় করে নেন। পরে শরৎচন্দ্র ঐ নাগা সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে দীক্ষা গ্রহন করেন। তিনি পরবর্তীতে তাঁর জমিদারী সকল সম্পত্তি ১৮৭৬ সালে শ্রীশ্রী আদিনাথ মন্দিরের নামে দেবত্তর সম্পত্তি হিসেবে উইল করে যান।
আদিনাথ দ্বৈত ব্যবস্থাপনা পুরী এ্যাক্ট অনুযায়ী মোহন্ত শাসনে ছিল। পরে মোহন্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ১৯১১ইং এর ব্যাস্থাপনা সীতাকুন্ড শ্রাইন কমিটির অধীনে চলে যায়। যা এখনও বর্তমান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার হ্যাজর তীর্থযাত্রী পূণ্য অর্জনের জন্য প্রতি নিয়ত যাতায়াত করে পূণ্য সঞ্চয় করে যান। এই শিব চতুর্দশী মেলা পক্ষ কাল ব্যাপী স্থাপিত হয়ে থাকে। উপমহাদেশের সকল স্থান থেকে সকল সম্প্রদায়ের ভীড়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে মিলন মেলা ও তীর্থ ক্ষেত্র। আবার অনেকেই প্রতিনিয়ত মানত করে যান মনসকামনাপূর্ণ হওয়া এবং দুঃখ যন্ত্রনা লাঘবের জন্য। আরও দেখা যায় মন্দিরের বিভিন্ন গাছে সুতা বা সুতলী বেধে মানত করেন, আবার সফলতা লাভ করে পুনরায় এসে সুতলীর বাঁধন খুলে পূজা পার্বণ দিতেও দেখা যায়। মহেশখালীতে কোন দূর্গা প্রতিমা বানানো হয় না। কারন স্বয়ং অষ্টভূজা দুর্গা জাগ্রত আছেন।
বর্তমানে আদিনাথ মন্দিরের নামে প্রায় ১৪৩ একর ভূমি দেবোত্তর হিসেবে রেকর্ডভুক্ত আছে বলে মন্দিরের ব্যবস্থাপক ও হিসাব রক্ষক লক্ষী চরণ দে জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন প্রায় ১৬০ একর ভূমি ডিসি খতিয়ানে খাস হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে যা বর্তমানে নবগঠিত নতুন কমিটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া প্রায় একশ একর ভূমি একশ্রেণীর প্রভাবশালী মহল কর্তৃক বেদখল হয়ে আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
0 Comments