দীপক কুমার পাল .মন্ডন মিশ্র আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন--বেদের আসল তাৎপর্য্য কর্ম। কর্মের জন্য সঞ্চিত সংস্কার বশতঃ জীবের পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ আত্মার বন্ধনের কারণ। প্রেয়কর্ম এবং অনুচিত কর্ম বর্জন করে বেদ নির্দেশিত নিত্যকর্মের অনুশীলনে প্রারব্ধ ক্ষয়ান্তে সকল কর্মের অবসান ঘটে এবং প্রচেষ্টা নিরপেক্ষ হয়ে আত্মার স্ব-স্বরূপে স্থিতি ঘটে। তাঁকে আর জন্ম ও মৃত্যুর বন্ধন স্বীকার করতে হয় না। এটাই মুক্তি। কর্মই মুক্তিদাতা, ঈশ্বর বা ব্রহ্ম নয়। অদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মের সঙ্গে আত্মার অভেদসাধন কল্পনা করে যে মুক্তির কথা বলে থাকেন—তা স্বকপোল কল্পিত।
এই ভাবে উভয়ের যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়ে আলোচনা ক্রমশঃ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর পর্য্যায়ে উন্নীত হতে থাকে। একাদিক্রমে সাতদিন বিচার যুদ্ধের পর অষ্টম দিনে মন্ডন মিশ্র বিচলিত হয়ে পড়লেন। বিচারের সূক্ষ্মতম পর্য্যায়ে পৌঁছে মন্ডন মিশ্র যুক্তির সূত্র হারিয়ে ফেলতে লাগলেন। মস্তিষ্কের উপর অত্যধিক চাপে মননশক্তি আর কাজ করছিল না। তাঁর সর্বাঙ্গে ঘাম দেখা দিল।
মন্ডনপত্নী উভয়ভারতী স্বামীর এই অবস্থা লক্ষ্য করে রায় দিলেন--আমার স্বামী পরাজিত হয়েছেন।
কিন্তু মন্ডন মিশ্রের স্বমতের ভ্রান্তির বিষয়ে দ্বিধা দূর হল না। মন্ত্রসিদ্ধ মন্ডন মিশ্র ‘মীমাংসা’ দর্শণের জনক জৈমিনী ঋষিকে আহ্বান করলেন। মহর্ষি জৈমিনী সূক্ষ্মশরীরে আবির্ভূত হয়ে বললেন—তুমি শঙ্করের যুক্তিতে সন্দেহ করো না। তিনি যা বলেছেন--তা সত্য।
মন্ডন মিশ্র আচার্য্য শঙ্করের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন--যদি উপযুক্ত মনে করেন, আমাকে সন্ন্যাসে দীক্ষিত করে কৃপা করুন।
উভয় ভারতী বললেন--আমার পতির পরাজয় এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। শাস্ত্রে আছে ‘আত্মনোহর্ধং পত্নী’। আমাকে পরাজিত করে আপনি আমার স্বামীকে শিষ্যত্বে বরণ করতে পারেন, তার আগে নয়। আমি জানি আপনি সর্বজ্ঞ, তবুও আপনার সঙ্গে বিচারে আমার ইচ্ছা হচ্ছে।
দ্বিধাগ্রস্ত শঙ্কর বললেন--একজন নারীর সঙ্গে বিচারে প্রবৃত্ত হতে আমার ইচ্ছা হচ্ছে না।
এ কথা শুনে উভয়ভারতী দৃপ্তকন্ঠে বললেন--আপনি নারীকে তুচ্ছ জ্ঞান করছেন কেন? যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি গার্গীর সঙ্গে বিচারে অগ্রসর হয়েছিলেন। রাজর্ষি জনক সুলভা নামে এক নারীর সঙ্গে বিচার করেছিলেন। তা যদি হয়ে থাকে--আমার সঙ্গে বিচারে আপনার অনীহা কেন?
উভয়ভারতীর ভর্ৎসনাপূর্ণ বাক্য শুনে আচার্য্য শঙ্কর দ্বিধা বিসর্জন দিয়ে বিচারে সম্মত হলেন। উভয় পক্ষে তুমুল বিচার আরম্ভ হোল। বেশ কয়েক দিন ধরে বিচার চললো।
উভয়ভারতী দেখলেন—বেদাদি নিখিলশাস্ত্রে আচার্য্যকে পরাস্ত করা অসম্ভব। অবশেষে একদিন বিচারের প্রারম্ভেই উভয়ভারতী এমন প্রশ্ন করলেন--যার জন্য আচার্য্য শঙ্কর প্রস্তুত ছিলেন না।
উভয়ভারতী প্রশ্ন করলেন—কামের লক্ষণ কি? কামের অবস্থান শরীরের কোন কোন অংশে? কোন কোন ক্রিয়া দ্বারা কামের আবির্ভাব এবং তিরোভাব ঘটে?।
প্রশ্ন শুনে আচার্য্য শঙ্কর কিছুক্ষণ অধোবদনে থেকে বললেন--দেবী! সন্ন্যাসীকে এই জাতীয় প্রশ্ন করা কি আপনার উচিৎ হচ্ছে?
উভয়ভারতী বললেন--কেন মহাত্মন্! কামশাস্ত্র প্রণেতা বাৎসায়ণ একজন ঋষি ছিলেন। কামশাস্ত্র কি শাস্ত্র নয়? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা অশাস্ত্রীয় কেন হবে?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আচার্য্য নিরুত্তর রইলেন। পত্নীর অশোভন প্রশ্নে বিচলিত মন্ডন মিশ্র বললেন--সন্ন্যাসীকে অসঙ্গত প্রশ্ন করে বিব্রত করা তোমার উচিৎ নয়।
উভয়ভারতী দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন--কামশাস্ত্র আলোচনায় যদি উনার চিত্তবিকার ঘটে তাহলে তো উনি তত্তজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হন নি। আপনার গুরু হওয়ার অনুপযুক্ত।
পত্নীর কথায় মন্ডন মিশ্র নিরুত্তর হলেন।
শঙ্কর বললেন--মা! আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি এক মাস সময় প্রার্থনা করছি।
এ মুখ দিয়ে নয়, গ্রন্থের সাহায্যে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবো। সন্ন্যাসীর মুখে কামের আলোচনা শাস্ত্রের অনুশাসন বিরোধী। ত্রিগুনাতীত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানীকেও লোকশিক্ষার জন্য ব্যবহারিক জগতে শাস্ত্রের মর্য্যদা দিয়ে চলতে হয়।
উভয়ভারতী সম্মতি জানিয়ে বললেন--আচ্ছা! তাই হবে। এক মাস আমরা আপনার প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষায় থাকবো।
আচার্য্য শঙ্কর মহিস্মতী ত্যাগ করে সশিষ্য যন্ত্রচালিতবৎ পূর্ব দিকে অগ্রসর হলেন। সামনে নিবিড় অরণ্য। অরণ্যের মধ্য দিয়ে কিছুদূর চলার পর হঠাৎ লক্ষ্য করলেন--একজন মৃত রাজাকে ঘিরে কয়েকজন রাজপুরুষ শোক করছেন। জিজ্ঞাসা করে জানলেন--শিকার করতে এসে রাজা অমরকের অকস্মাৎ প্রাণবিয়োগ ঘটেছে।
এহেন যোগাযোগ দেখে আচার্য্য শিষ্যদের বললেন--তোমরা তাড়াতাড়ি একটা নিরাপদ গুহার সন্ধান কর। আমি রাজার দেহে প্রবেশ করবো।
অল্পক্ষণের মধ্যে একটা গুহার সন্ধান পাওয়া গেল। আচার্য্য গুহায় প্রবেশ করে বললেন--আমি বিদেহী হয়ে রাজার দেহে প্রবেশ করছি। তোমরা সতর্কতার সঙ্গে পাহারা দিয়ে আমার দেহটা রক্ষা করবে। এক মাস পরে পুনরায় এসে আমি এ দেহে প্রবেশ করবো।
এদিকে রাজার দেহে প্রাণের লক্ষণ দেখে উল্লসিত রাজপুরুষেরা পরম যত্নে রাজা অমরককে রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনলেন।
রাজদেহে বাস করে কামশাস্ত্রে পারদর্শী হওয়ার জন্য শঙ্করাচার্য্য কামকলার অনুশীলন করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ভারতীর প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ রতিবিজ্ঞান বিষয়ক একখানি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করলেন।
একমাস পরে তিনি যোগবলে নিজের পরিত্যক্ত দেহে পুনরায় প্রবেশ করে মন্ডন মিশ্রের গৃহাভিমুখে অগ্রসর হলেন।
আচার্য্যকে দেখে মন্ডন মিশ্র এবং উভয়ভারতী খুবই আনন্দিত হলেন। আচার্য্য উভয়ভারতীর হাতে গ্রন্থটি তুলে দিয়ে বললেন--আপনার প্রশ্নের উত্তর এই গ্রন্থে পাবেন।
উভয়ভারতী গ্রন্থখানি আদ্যন্ত ভাল করে দেখে প্রীত হয়ে বললেন--আপনার জয় সম্পূর্ণ হয়েছে। অনুগ্রহ করে আমার পতিদেবকে শিষ্যত্বে বরণ করে তাঁর মনুষ্যজীবন সার্থক করুন। আমি নিশ্চিন্তমনে এবার স্বধামে ফিরে যাবো।
উভয়ভারতীর কথা শুনে আচার্য্য শঙ্কর করজোড়ে বললেন--আমি জানি আপনি সরস্বতী স্বয়ং। কৃপাপরবশ হয়ে আরও কিছুকাল মরদেহে অবস্থান করুন এবং মানুষের অজ্ঞানতা নাশ করে জগতের কল্যাণ করুন। শৃঙ্গেরীতে একটা মঠ স্থাপনের ইচ্ছা আছে। কৃপা করে আপনি সেখানে অধিষ্ঠিত হয়ে মুমুক্ষু সকলকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করুন।
শঙ্করের ঐকান্তিকতা দেখে উভয়ভারতী সবিনয়ে বললেন--যতিবর! শৃঙ্গেরীতে আপনি শ্রীযন্ত্র স্থাপন করুন। বিদেহী হয়েও আমি ঐ যন্ত্রে সর্বদা বিরাজিত থাকব।
এই কথা বলে উপস্থিত সকলের নিকট বিদায় প্রার্থনা করে উভয়ভারতী যোগারূড়া হয়ে পার্থিব দেহ ত্যাগ করলেন।
পত্নীর পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে মন্ডন মিশ্র আচার্য্যের নিকট যথাবিধি সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন।
মন্ডন মিশ্র সুরেশ্বরাচার্য্য নামে পরিচিত হলেন। আচার্য্য শঙ্কর শিষ্য সুরেশ্বরকে ‘তত্ত্বমসি’ বোধে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরম যত্নে শিক্ষা দিতে লাগলেন। এই উদ্দেশ্যে আচার্য্য শঙ্কর সুরেশ্বরকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন--তা ‘তত্ত্বোপদেশ’ নামক ক্ষুদ্র পুস্তিকায় সংকলিত হয়েছে।
আচার্য্যের শরণ নিয়ে মন্ডন মিশ্রের জীবনের যে সার্থক রূপান্তর ঘটেছিল এবং গুরুর প্রতি তিনি যে কতখানি কৃতজ্ঞতা পোষণ করতেন--তা আমরা বুঝতে পারি তাঁর রচিত শঙ্করাচার্য্যের প্রশস্তিসূচক স্তব থেকে।
সুরেশ্বরাচার্য্য বলেছিলেন--হে করুণাময় সদ্গুরু! আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করুন। আপনার মহিমা উপলব্ধি না করেই আমি আপনার সঙ্গে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। পূর্বজন্মের বহু সুকৃতির ফলে আপনার চরণে আশ্রয় পেয়ে আমার মানবজীবন ধন্য হয়েছে। কৃপাকণা দিয়ে আপনি সংসারবন্ধন হতে আমায় মুক্ত করেছেন।
মন্ডন বিজয়ের পর আচার্য্য শঙ্কর শিষ্যদের নিয়ে বৈদিক আদর্শের বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে বিচারের জন্য বহির্গত হলেন। এখন হতে আচার্য্য শঙ্করকে আমরা দেখতে পাবো ধর্মসংস্থাপক রূপে।
মন্ডন মিশ্রের পরাজয়ের পর খুব কম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরুস্থানীয় পন্ডিত ব্যক্তি আচার্য্য শঙ্করের সঙ্গে বিচারে অগ্রসর হতে সাহসী হয়েছিলেন। তবুও বহু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে আচার্য্য শঙ্কর মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তাঁদের মতবাদকে বেদানুগামী করে সনাতন হিন্দুধর্মের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন।
এই সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানা ঘটনায় শঙ্করের ব্যক্তিত্বের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকটিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। কৌতূহল উদ্দীপক কয়েকটি বিচারের ঘটনা উল্লেখ করবো।
মহিস্মতী হতে বিদায় নিয়ে পথিমধ্যে চালুক্যরাজ্যের বিভিন্ন ধর্মস্থান পরিক্রমা করে আচার্য্য এলেন পুরাণ বর্ণিত পঞ্চবটীতে। কালের প্রভাবে এখানে শ্রীরামচন্দ্রের মন্দিরটি ভগ্নদশা প্রাপ্ত এবং পরিত্যক্ত হয়েছিল। তিনি মন্দিরটি সংস্কার করে যথাবিধি পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন। মন্দিরের পাশে সন্ন্যাসীদের বসবাসের জন্য একটা মঠ স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।
এরপর তিনি চন্দ্রভাগা নদী তীরস্থ পন্ডরপুরে এলেন। এখানে শ্রীপাণ্ডুরঙ্গদেব বিশেষ জাগ্রত দেবতা। দেবদর্শনে ভাববিহ্বল আচার্য্য একটা স্তব রচনা করে পাণ্ডুরঙ্গের বন্দনা করলেন।
আচার্য্যের ভাবাবেশ দর্শনে উপস্থিত জনসাধারণ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। উপদেশপ্রার্থী সকলকে তিনি বেদমার্গ অনুসরণ করে স্বধর্মনিষ্ঠ হওয়ার উপদেশ দিলেন। আচার্য্যের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে ঐ অঞ্চলে ধর্মভাবের জাগরণ ঘটে।
তারপর আচার্য্য এলেন কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর সঙ্গমস্থলে শ্রীশৈল নামক প্রসিদ্ধ তীর্থে। অতি প্রাচীন কাল হতে এই স্থান ছিল পশুপত, শৈব, বৈষ্ণব ও বামাচারী শক্তিসাধকদের পীঠস্থান।
আচার্য্যের আগমনে সমগ্র শ্রীশৈলে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হোল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় পন্ডিত ও সাধকগণ নিজ নিজ মতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আশায় আচার্য্যের সঙ্গে বিচারের জন্য আসতে লাগলেন। কিন্তু পদ্মপাদ ও সুরেশ্বরাচার্য্যের নিকট পরাভূত হয়ে অধিকাংশই ক্ষুন্ন মনে ফিরে গেলেন।
আচার্য্যের ব্রহ্মাত্ম-তত্ত্ব প্রচার এবং তদাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ত্যাগ ও সংযম সাধনের উপদেশ স্থানীয় তান্ত্রিকদের বিচলিত করে তুললো।
কাপালিক গুরুগণ আচার্য্যের নিকট পরাভূত হচ্ছেন শুনে স্থানীয় কাপালিক রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে কৌশলে আচার্য্যের প্রাণ নাশের জন্য শ্রীশৈলের কাপালিকপ্রধান উগ্রভৈরবকে নিযুক্ত করলেন।
কপটাচারী উগ্রভৈরব একদিন এসে আচার্য্যের চরণে ভক্তিভরে প্রণাম করে আন্তরিকতার সুরে বললেন যে তিনি নিজ শক্তিমত পরিত্যাগ করে আচার্য্যের চরণে শরণ নিতে এসেছেন। অবশিষ্ট জীবন তিনি গুরুর চরণসেবা করে কাটিয়ে দিতে চান।
উগ্রভৈরবের কাতরতা দেখে আচার্য্যের মনে দয়ার সঞ্চার হোল। তিনি তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করে নিলেন।
অল্প দিনের মধ্যেই বিনীত ব্যবহার এবং অক্লান্ত সেবার দ্বারা উগ্রভৈরব সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন।
একদিন নিরালায় পেয়ে আচার্য্যকে তিনি বললেন--আমি জানি আপনি অবতার। জীব উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন। করুণার মূর্তি আপনি। জানি--ভক্তবাঞ্ছা পূরণে আপনার অদেয় কিছু নেই। দুঃখের বিষয়--আমার একমাত্র অভীষ্ট অপূর্ণ রয়ে গেছে।
শঙ্কর স্নিগ্ধকন্ঠে বললেন--কি তোমার ইচ্ছা—বল।
উগ্রভৈরব অশ্রুপূর্ণ নয়নে বলতে লাগলেন--শিবলোক প্রাপ্ত হওয়ার জন্য উগ্র সাধনা করে আমি মহাদেবের বর পেয়েছি--যদি আমি কোন রাজা বা সর্বজ্ঞের মস্তক দ্বারা হোম করতে পারি, তাহলে আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।
রাজা বা সর্বজ্ঞের মস্তক সংগ্রহের জন্য বহু চেষ্টা করেও আমি সফলকাম হই নি। করুণাময়! আপনার কৃপা হলে আমার জীবন সার্থক হতে পারে।
উগ্রভৈরবের প্রার্থণা শুনে আচার্য্য শঙ্কর বললেন--ব্রহ্মাত্মবোধে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্য্যন্ত জন্ম, মৃত্যুর প্রহেলিকা হতে মানুষের পরিত্রাণ নেই। সাধনার দ্বারা লোকপ্রাপ্তি ঘটলেও বারংবার দেহ ধারণ করে ত্রিতাপ জ্বালা ভোগ করতে হয়। ব্রহ্মজ্ঞান ছাড়া পরাশান্তি লাভ হয় না। বিবেকী ব্যক্তি লোক প্রাপ্তির (শিবলোক ইত্যাদি) আশা করেন না।
আচার্য্যের কথা শুনে উগ্রভৈরব ব্যাকুল ভাবে বলতে লাগলেন--আপনি জানেন, আমি অদ্বৈতজ্ঞানের অধিকারী হওয়ার যোগ্য নই। বৃদ্ধ হয়েছি। কত দিন আর বাঁচবো! দয়া করে আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করুন। শুনেছি--দধীচিমুনি ইন্দ্রকে নিজের অস্থি দান করে অমর কীর্তির অধিকারী হয়েছিলেন। আমার কল্যাণে আপনার নশ্বর দেহটা দান করে আপনিও যশস্বী হোন, সেই সঙ্গে আমার মানবজীবন সার্থক করুন।
অবুঝ উগ্রভৈরবের আর্তি শুনে আচার্য্য স্থির থাকতে পারলেন না। বললেন--তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। কিন্তু কি ভাবে কাজটা সম্ভব? শিষ্যেরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলে তোমার অভিষ্ট সিদ্ধ হবে না।
আনন্দে আত্মহারা উগ্রভৈরব গুরুর চরণে লুটিয়ে পড়ে বললেন--আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করবো। কেউ কিছু জানতে পারবে না। নিকটেই বনের গভীরে ভৈরবের স্থান আছে। আগামী অমাবস্যার রাতে সকলে নিদ্রিত হলে আমি এসে গোপনে আপনাকে নিয়ে যাবো।
নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন কোন প্রয়োজনে স্থানান্তরে যাওয়ার অছিলায় উগ্রভৈরব চলে গেলেন।
পরের দিন অমাবস্যার গভীর রাতে শিষ্যদের সকলকে নিদ্রিত দেখে আচার্য্য প্রস্তুত হতেই উগ্রভৈরব এসে উপস্থিত হুলেন। অন্ধকারে পথ দেখিয়ে উগ্রভৈরব আচার্য্যকে বনের গভীরে নিয়ে গেলেন।
আচার্য্য দেখলেন--পূজার সব আয়োজন প্রস্তুত।। হোমাগ্নি প্রজ্জ্বলিত রয়েছে।
উগ্রভৈরব ব্যাগ্রভাবে বললেন--প্রভু! শুভক্ষণ উপস্থিত। প্রজ্জ্বলিত হোমকুণ্ডের সন্মুখবর্তী কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তরখণ্ড দেখিয়ে উগ্রভৈরব বললেন--ঐ প্রস্তরের উপর আপনার মস্তক স্থাপন করুন।
আচার্য্য শান্ত ভাবে বললেন--একটু অপেক্ষা কর। আমি সমাধিস্থ হই, তারপর তুমি তোমার কাজ করবে।
সেই মুহূর্তে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। পদ্মপাদ স্বপ্ন দেখলেন--এক কাপালিক নির্জণ বনের মধ্যে গুরুদেবের মস্তক ছেদনের জন্য উদ্যত হয়েছে। আতঙ্কিত পদ্মপাদ আরাধ্য নৃসিংহদেবকে স্মরণ করা মাত্রই ভয়ানক মূর্তিতে নৃসিংহদেব পদ্মপাদের দেহে আবিষ্ট হলেন।
ভীষণ গর্জন করে পদ্মপাদ অকস্মাৎ শয্যা ত্যাগ করে সিংহবিক্রমে বনের দিকে ধাবিত হলেন।
প্রলয়ঙ্কর গর্জন শুনে সকল শিষ্যের নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছিল। তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পদ্মপাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন।
নৃসিংহদেবাবিষ্ট পদ্মপাদ বজ্রগম্ভীর গর্জনে বনভূমি প্রকম্পিত করতে করতে ঝড়ের বেগে ভৈরবস্থানে হাজির হলেন। নিমেষের মধ্যে উগ্রভৈরবের হাতের উদ্যত খড়্গ কেড়ে নিয়ে তাঁর শিরচ্ছেদ করলেন। কাপালিকের ছিন্ন মস্তক ছিট্কে পড়লো হোমকুণ্ডের পাশে। কবন্ধ দেহের রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়ে হোমগ্নির আলোয় পরিবেশটিকে বীভৎস করে তুললো। উপস্থিত আচার্য্যের শিষ্যগন এই ভীষণ দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাপালিকের অনুচরগণ আতঙ্কিত হয়ে পলায়ন করলো।
পদ্মপাদ তখনো উন্মত্তের মত গর্জন করে চলেছেন। আচার্য্যের সমাধি ভঙ্গ হয়েছিল। পদ্মপাদের দেহাবিষ্ট নৃসিংহদেবরূপী নারায়ণের ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে আচার্য্য করজোড়ে স্তব করতে লাগলেন। সহসা নৃসিংহদেব অন্তর্হিত হলেন। পদ্মপাদ মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন।
ক্রমশঃ
0 Comments