
দীপক কুমার পাল দিক্প্লাবী প্রজ্ঞার দ্যুতি, অমানুষিক কর্মকুশলতা এবং অভাবনীয় দূরদৃষ্টির অধিকারী ধর্মসংস্থাপক, ধর্মসংস্কারক ও সংগঠক হিসাবে শঙ্করাচার্য্য অদ্বিতীয়।
সমসাময়িক কোন যোগ্য ব্যক্তি বা তাঁর প্রতিভাবান শিষ্যমণ্ডলীর কেউ শঙ্করাচার্য্যের প্রামাণিক জীবনী লিখে যান নি। আচার্য্য শঙ্করের অনেকগুলি জীবনীগ্রন্থ প্রচলিত আছে। কিন্তু সেগুলো পরবর্তী কালের রচনা। এবং অধিকাংশই কিংবদন্তী নির্ভর।
আনন্দগিরি রচিত ‘শঙ্কর বিজয়’ এবং মাধবাচার্য্য রচিত ‘শঙ্কর দিগ্বিজয়’—এই দুটি গ্রন্থ প্রামাণ্য ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ হলেও বহুলাংশে জনশ্রুতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
শঙ্করের অধুনালব্ধ জীবনকাহিনীগুলোর মধ্যে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সমূহ এমন ওতঃপ্রোত ভাবে মিশে আছে যে অলৌকিকতার কূহেলী অপসারিত করে তাঁর জীবনের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা দুরূহ কাজ।
কিন্তু সনাতন হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনে আচার্য্য শঙ্করের অবদানের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই। অলোকসামান্য মননশীলতা, সুগভীর তত্ত্বজ্ঞান--যা তিনি তাঁর গ্রন্থে রেখে গিয়েছেন, তা কালের প্রভাব অতিক্রম করে আজও স্বমহিমায় বর্তমান। ভবিষ্যতেও অনুরূপ ভাবে বর্তমান থাকবে, কারণ তা শাশ্বত সত্যের প্রকাশক।
আচার্য্য শঙ্করের বিশ্বাস অনুযায়ী অদ্বৈত সত্যের বোধে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই মানুষের ধর্মসাধনার শেষ কথা। বেদান্তের অভেদসত্যই তাঁর প্রচারিত ধর্মীয়দর্শণের মূল ভিত্তি।
তাঁর দার্শণিক অনুসন্ধিৎসার ফলশ্রুতি হোল--জগৎ মায়াদ্বারা সৃষ্ট, অর্থাৎ মায়ামাত্র। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োজনে জগৎ, সংসারের আপেক্ষিক সত্যতা ও গুরুত্বকে তিনি অস্বীকার করেন নি।
একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর ছিল না। অদ্বৈতবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধিকারী ভেদে মানুষকে নানা দ্বৈত উপাসনার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর মতে সাকার উপাসনা চিত্তশুদ্ধির সহায়ক এবং ক্রমে সাধক নিরাকার অদ্বৈতসত্যের ধারণা করতে সক্ষম হয়।
তিনি প্রায়শই উপদেশ প্রার্থীকে পঞ্চ দেবতার পূজা এবং পঞ্চ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে বলতেন।
তাঁর সাম্যদৃষ্টিতে দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, পূর্ণাদ্বৈত--সব কিছুই যথাযোগ্য স্থান পেয়েছে।
অদ্বৈতভূমিতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত সমন্বয়বাদী শঙ্কর বিষয়াসক্ত, ত্রিতাপজ্বালায় দগ্ধ মানুষের সার্বিক কল্যাণ ভাবনার মূর্তপ্রকাশ স্বরূপ ছিলেন। চরম জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে শ্রেয়ের পথে পরিচালনার জন্য তাঁকে আমরা সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার রূপকার হিসাবে অক্লান্ত কর্মীর ভূমিকায় দেখতে পাই।
ভারতবর্ষে সহস্র বৎসর ব্যাপী বৌদ্ধধর্মের আধিপত্যের অন্তিমলগ্নে এই ধর্ম যখন গতিময়তা হারিয়ে, নানা শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে নিষ্প্রাণ আচারসর্বস্বতায় পরিণত হয়--সেই সময় যুগের প্রয়োজনে বৈদিকধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটাবার জন্য শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাব ঘটে।
তৎকালে বৌদ্ধধর্মের প্রাবল্যে বেদাশ্রিত হিন্দুধর্মের নানা শাখা মূলস্রোত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের নানা প্রান্তে ক্ষুদ ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছিল। তাঁরা নিজেদের ধর্মমতকে বেদভিত্তিক বলে দাবী করতেন। আসলে বৈদিক আদর্শচ্যুত হয়ে এই সব ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অধ্যাত্মপ্রগতির অন্তরায়স্বরূপ নানা কাল্পনিক উপাসনা পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
সম্প্রদায় ভিত্তিক এই সকল ধর্মীয় মতবাদের সংস্কার এবং বৈদিক ধর্মাদর্শের ছত্রছায়ায় তাদের সমন্বয় সাধন করা আচার্য্য শঙ্করের কর্মকাণ্ডের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
অনেকের মতে ৬৮৬ সালে, মতান্তরে ৭৮৮ সালে কেরল প্রদেশের অখ্যাত আলোয়া গ্রামে শঙ্করাচার্য্য জন্মগ্রহণ করেন।
অলৌকিক কিংবদন্তী যতটা সম্ভব বাদ দিয়ে শঙ্করের অমর কীর্তিসম্বৃদ্ধ স্বল্পায়ু জীবনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। তার আগে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরী।
অদ্বৈতবেদান্তের যে ধারণার সঙ্গে আজ আমরা পরিচিত--যা স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ ইত্যাদি মনীষী দ্বারা প্রচারিত হয়ে আজ বিশ্বের সারস্বত সমাজের সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি অর্জণ করেছে--সেই বেদান্তদর্শণকে সর্বপ্রথম যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের উপর দাঁড় করিয়েছিলেন আচার্য্য শঙ্কর।
অদ্বৈতদর্শণ যা অদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত--সেটির আদি রূপ ব্যাসদেব ( কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস) কৃত ব্রহ্মসূত্রে সূত্রাকারে নিহিত থাকায়, দুরূহ ও দুর্বোধ্যতার জন্য ব্রহ্মসূত্র সহস্রাধিক বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। আচার্য্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করে মানুষের অনুসরণ যোগ্য সর্বোচ্চ একটা দার্শণিক তত্ত্বের রূপ দেন।
বৈদিক ধর্মের পুনর্জাগরণ মানসে আচার্য্য শঙ্করের কর্মকাণ্ডের কয়েকটি দিক আছে।
আসমুদ্র হিমালয় ব্যাপী সমগ্র ভারতে পরিব্রাজক সন্ন্যাসীরূপে তিনি একদিকে প্রসিদ্ধ হিন্দুতীর্থস্থানগুলির লুপ্তপ্রায় মহিমা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। অবহেলায় পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায়, বিগ্রহশূণ্য বিখ্যাত মন্দিরগুলোর সংস্কার করেছেন এবং বিগ্রহ স্থাপন করে পূজার পুনঃ প্রচলন করেছেন। এমন কি বিলুপ্ত পূজাপদ্ধতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁকে অনুসরণকারী শত শত ব্রাহ্মণপন্ডিতদের মধ্য হতে কয়েক জনকে এইসব মন্দিরে রেখে গিয়েছেন।
বৌদ্ধধর্মের আধিপত্যের যুগে ভারতের নানা অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু সম্প্রদায় তখন পর্য্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল এবং যারা নিজেদের ধর্মীয় সিদ্ধান্তের অভ্রান্ততা বিষয়ে আত্মগরিমা বোধ করতো--আচার্য্য শঙ্কর দিগ্বিজয়ী বীরের মত সেই সব সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় পন্ডিতদের তর্কবিচারে আহ্বান জানাতেন। অপরিমেয় শাস্ত্রজ্ঞান ও ক্ষুরধার বিচার শক্তির সাহায্যে আচার্য্য শঙ্কর অনায়াসে তাদের ভ্রান্তিগুলিকে প্রমাণিত করে স্বমতে আনতে সক্ষম হতেন।
লক্ষ্যনীয় বিষয়--এই সব বিচারযুদ্ধের পরিণামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরাজিত ধর্মগুরু তাঁর অনুগামী ভক্ত এবং শিষ্যমন্ডলী সমেত আচার্য্য শঙ্করের মত ও পথের অনুগামী হয়েছেন। তিনি তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন --তাঁরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা কাল্পনিক, বেদ তা অনুমোদন করে না। এইরূপ অনুশীলনের দ্বারা আধ্যাত্মিক প্রগতি ঘটা সম্ভব নয়।
আচার্য্য শঙ্কর ভ্রান্ত ধর্মমতের সংস্কারসাধন করে দিয়ে তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়ের ধর্মই অনুসরণ করার পরামর্শ দিতেন।
আচার্য্য শঙ্করের ধর্মবিজয় যাত্রা চমকপ্রদ দর্শনীয় ব্যাপার ছিল। তাঁর বিজয়বাহিনীর সঙ্গে অনেক সময় তিন সহস্রাধিক মানুষ অনুগমন করতেন। সেই শোভাযাত্রায় বাদ্যযন্ত্র, ধ্বজা পতাকা, সাধু সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ পন্ডিত এবং শত শত ধর্মপিপাসু স্থানীয় মানুষকে দেখা যেত। অনেক সময় স্থানীয় রাজা শঙ্করাচার্য্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শণ এবং তাঁর নিরাপত্তার জন্য সৈন্য সামন্ত নিয়ে শোভাযাত্রায় যোগ দিতেন। শঙ্করাচার্য্যের চলার রাস্তা পরিস্কার করার জন্য লোকলস্কর, রসদ বহনের জন্য হাতি, ঘোড়াও তাঁরা সঙ্গে আনতেন।
পরিব্রাজক শঙ্কর যাত্রাবিরতি স্থলে অনুগামীদের নিয়ে তত্ত্ব আলোচনা করতেন। অধ্যাপনা এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে শাস্ত্রবিচারের সময়টুকু ছাড়া অন্য সময় আচার্য্য শঙ্কর বাহ্যজগৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ ও আত্মসমাহিত অবস্থায় থাকতেন, তাঁকে দেখলেই তা বোঝা যেতো।
বৈদিকধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্প বহন করে তিনি যখন কোন প্রখ্যাত পান্ডিত্যাভিমানীর সঙ্গে বিচারযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন--তাঁর মধ্যে যে উদ্যম, একাগ্রতা এবং জিগীষা দেখা যেত তার কোনটাই আত্মপ্রতিষ্ঠার অহংকার প্রসূত ছিল না; ফলে পান্ডিত্যের সঙ্গে তাঁর মধ্যে যে শালীনসৌজন্য, প্রশান্তসহনশীলতা, সর্বোপরি করুণাঘন কল্যাণমূর্তির প্রকাশ ঘটতো তা অতি সহজেই প্রতিপক্ষের চিত্তকে জয় করে নিত।
নিঃস্বার্থ কর্তব্যবোধের দ্বারা চালিত হয়ে তিনি বিশাল ভারতের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল তৎকালীন মৃতপ্রায় বৈদিকধর্মে প্রাণশক্তি সঞ্চার করা।
সুদূরপ্রসারী অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে তিনি আর একটি বৃহৎ কাজ করেছিলেন, তা হলো--চারটি বেদের আদর্শকে সামনে রেখে ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠের প্রতিষ্ঠা। যেগুলি ভবিষ্যতে সুদৃঢ় দুর্গের মত সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বৈদিক ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিরক্ষা বলয়ের মত কাজ করবে।
বৈদিক ধর্মকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি আর একটি স্মরণযোগ্য কাজ করেছেন, ভারতের অসংখ্য ত্যাগী সন্ন্যাসীদের দশটি শাখায় বিভক্ত করে দশনামী সাধুসম্প্রদায়ের সৃষ্টি। উদ্দেশ্য ছিল সংস্কার ও রুচি ভেদে বেদাশ্রিত সনাতনধর্মের বিভিন্ন ধারাকে সজীব এবং গতিময় রাখা।
দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নাগা সন্ন্যাসীদের সমগ্র সন্ন্যাসীসমাজের রক্ষাকর্তা হিসাবে সামরিক আদর্শে অস্ত্র ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন--আচার্য্য শঙ্করের জীবনাবসানের দুই শত বছরের মধ্যেই ভারতে মদমত্ত ইস্লামিক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আচার্য্য শঙ্করের পরবর্তী এক হাজার বছর ভিন্নধর্মী পরাক্রমশালী মুসলিম এবং বৃটিশ শাসকদের অধীনে শত প্রতিকূলতার মধ্যে সনাতন হিন্দুধর্ম যে স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল--তার পিছনে শঙ্করাচার্য্যের অবদান কতখানি তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।
পরাধীনতার এই সুদীর্ঘ সময়কালে বিজাতীয়, বিরুদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে ভারতের নানা অঞ্চলে শত শত সন্ত, মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁরা নিরন্তর সনাতন ধর্মে নবীন প্রেরণা সঞ্চার করে এই ধর্মকে সজীব, প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করেছিলেন। এটা সম্ভব হোত না—যদি আচার্য্য শঙ্কর তাঁর অনন্যসাধারণ দূরদৃষ্টি এবং সাংগঠনিক প্রতিভা বলে বৈদিকধর্মকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে না যেতেন।
যদি শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাব না ঘটতো তাহলে হয়তো ইসলামধর্মের প্রবল চাপের মুখে ভারতে বৈদিকধর্ম নিজের অস্তিত্ব বিকিয়ে দিতে বাধ্য হোত, যেমনটা প্রায় ঘটতে দেখা গিয়েছিল পূর্ববর্তী বৌদ্ধধর্মের প্রবল আধিপত্যের যুগে।
আচার্য্য শঙ্করের পিতা শিবগুরু শাস্ত্রানুরাগী, আচারনিষ্ঠ এবং কঠোর সত্যপরায়ণ নামপুদ্রি ব্রাহ্মণ ছিলেন। ক্ষুদ্র পরিবার প্রতিপালনের সাথে তিনি শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনায় সময় কাটাতেন। সামান্য বিষয়সম্পত্তির আয়ে তাঁর সংসার প্রতিপালিত হোত।
আচার্য্য শঙ্করের জীবনে তাঁর মা বিশিষ্টাদেবীর বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি ভক্তিমতি, সহনশীলা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা ছিলেন।
কথিত আছে নিঃসন্তান বাহ্মণদম্পতি বার্ধ্যকের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে পুত্রসন্তান লাভের আশায় গ্রামের অনতিদূরে চন্দ্রমৌলীশ্বর শিবের মন্দিরে ব্রত গ্রহণ করে কেবলমাত্র শিবের চরণামৃত এবং সামান্য কন্দমূল আহার করে এক বৎসর ব্যাপী কঠোর কৃচ্ছসাধন দ্বারা শিবের আরাধনা করেন।
অবশেষে একদিন জ্যোতির্ময় মূর্তিতে শিব আবির্ভূত হয়ে বরদান করতে চাইলেন একটি শর্তে—‘সর্বজ্ঞ পুত্র চাও তো সে দীর্ঘায়ু হবে না, আর যদি দীর্ঘায়ু পুত্র চাও তো সে সর্বজ্ঞ হবে না। বল কি চাও!’
ধর্মনিষ্ঠ শিবগুরু সর্বজ্ঞ পুত্র চাইলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন--তোমরা ঘরে ফিরে যাও। আমি তোমাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করবো।
যথাসময়ে তাঁরা একটি কমনীয়কান্তি পুত্রসন্তান লাভ করেন। শিবের বরে প্রাপ্ত পুত্রের নাম রাখলেন শঙ্কর।
ছেলেবেলা থেকেই শঙ্কর ধীরস্থির শান্ত প্রকৃতির এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। শ্রুতিধর বালক অতি অল্প বয়সেই রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ শুনে মুখে মুখে বলতে পারতেন।
পুত্রের অসাধারণ মেধা লক্ষ্য করে পিতা শিবগুরু স্থির করলেন--পাঁচ বছর বয়সে পুত্রের উপনয়ন সম্পন্ন করে তাঁকে গুরুগৃহে পাঠাবেন। কিন্তু অকস্মাৎ শিবগুরুর জীবনাবসান ঘটলো। শোকাতুরা বিশিষ্টা দেবী পুত্রকে নিয়ে কিছু দিনের জন্য পিতৃগৃহে আশ্রয় নিলেন।
শঙ্কর পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করতেই বিশিষ্টাদেবী মৃত পতির ইচ্ছার কথা স্মরণ করে পুত্রকে নিয়ে আলোয়া গ্রামে ফিরে এলেন এবং উপনয়ণ সম্পন্ন করে পুত্রকে গুরুগৃহে পাঠালেন।
শ্রুতিধর মেধাবী শঙ্কর দুবছরের মধ্যেই সমস্ত পাঠ্যবিষয় আয়ত্ব করে শিক্ষাগুরুর অকুন্ঠ আশীর্বাদ লাভ করলেন এবং সমাবর্তনের অনুমতি পেলেন।
শাস্ত্রের বিধান অনুসারে গুরুগৃহ হতে প্রত্যাবর্তনের পরেই বিশিষ্ঠাদেবী প্রতিবেশী একটি সুন্দরী কন্যার সঙ্গে পুত্রের বিয়ে দেবেন মনস্থ করলেন। মায়ের শত অনুনয় এবং অশ্রু বর্ষণেও স্থিরপ্রতিজ্ঞ শঙ্কর বিয়েতে সম্মত হলেন না। বালকের দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় পেয়ে বিশিষ্টাদেবী এবং প্রতিবেশী অনেকে বিস্মিত হলেন।
শঙ্কর মাতৃভক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি মায়ের সেবা এবং মাকে খুশি রাখার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতেন।
সেকালের রীতি অনুযায়ী জন্মের পরেই দৈবজ্ঞেরা জাতকের কুষ্ঠি রচনা ও বিচার করে বলেছিলেন--আট বছর বয়সে জাতকের মৃত্যুযোগ রয়েছে। দৈবইচ্ছায় সেই মৃত্যুযোগ কাটিয়ে উঠতে পারলে জাতক মহান পুরুষ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করবে এবং জাতকের আয়ু আঠার বছর বয়স পর্য্যন্ত বর্ধিত হবে।
শঙ্কর আট বছরে পদার্পণ করতে চলেছেন--পুত্রকে হারানোর ভয়ে বিশিষ্টাদেবী সদা শঙ্কিত। শঙ্করও তাঁর মৃত্যুযোগের কথা জানতেন। তিনি শুনেছেন--সন্ন্যাস ছাড়া আত্মজ্ঞান লাভ হয় না। আত্মজ্ঞান ব্যতিত মুক্তিলাভ অসম্ভব। কাজেই তাঁর সব সময় এক চিন্তা--কি ভাবে মাকে রাজী করিয়ে সন্ন্যাস নেবেন।
সুযোগ বুঝে শঙ্কর একদিন সন্ন্যাসের কথা বলতেই পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা কাতরকন্ঠে বলতে লাগলেন--তুমি আমার একমাত্র অবলম্বন। তুমি চলে গেলে এই বৃদ্ধবয়সে কে আমাকে দেখবে! আমাকে তীর্থধর্ম কে করাবে! মৃত্যু হলে মুখাগ্নি কে করবে! আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে সন্ন্যাসী হতে দেবো না। আমি আর কতদিন? আমার মৃত্যুর পর তুমি সন্ন্যাসী হয়ো।
নিরুপায় শঙ্কর ঈশ্বরের নিকট কাতর প্রার্থণা জানাতে লাগলেন। শঙ্করের সন্ন্যাস কিভাবে সম্ভব হয়েছিল সে সম্বন্ধে প্রচলিত কাহিনীটি এইকরম--শঙ্কর একদিন মায়ের সঙ্গে গ্রামের পার্শ্ববর্তী আলোয়াই নদীতে স্নান করতে গিয়েছেন। গ্রামের অনেকেই তখন নদীতে স্নান করছিলেন। মা স্নান করে তীরে উঠেছেন। শঙ্কর তখনও নদীতে। হঠাৎ এক কু্মীর শঙ্করের পা ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো, তা দেখে স্নানরত কেউ কেউ শঙ্করের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হলেন।
অন্তিম সময় উপস্থিত দেখে অবসন্ন শঙ্কর চিৎকার করে মাকে বললেন--তুমি যদি এখনও আমাকে সন্ন্যাসের অনুমতি দাও, আমি মানসসন্ন্যাস গ্রহণ করে প্রাণত্যাগ করতে পারি।
শঙ্করের জীবনের আশা নেই দেখে মা অনুমতি দিলেন। এদিকে অনতি দূরে জেলেরা নৌকায় মাছ ধরছিল। তারা দ্রুত এসে জাল ফেলে কুমীরটাকে ঘিরে ফেললো। কুমির তখন শঙ্করকে ছেড়ে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু জেলেদের জালে ধরা পড়ে গেল।
আহত শঙ্করকে জল থেকে তুলে শুশ্রূষা চলতে লাগলো। কবিরাজ ডেকে এনে ওষুধ প্রয়োগ করে ক্ষতস্থান বেঁধে দেওয়া হলো। একটু সুস্থ বোধ করলে গ্রামবাসীরা শঙ্করকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন।
শঙ্কর মাকে বললেন--আমি এখন সন্ন্যাসী, বাড়িতে বাস করতে পারি না। কাছেই গাছের তলায় আজ রাতের মত আশ্রয় নেবো।
মায়ের শত অনুনয়েও শঙ্কর স্বীয়সংকল্পে অটল রইলেন। মাকে আশ্বস্ত করে বললেন--আমি এখনই আত্মীয়দের ডেকে তোমার ভরণপোষণের জন্য বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোমার অন্তিমকাল উপস্থিত হলে আমি যেখানেই থাকি না কেন--স্মরণমাত্রই উপস্থিত হব। তোমাকে ইষ্টদর্শণ করাবো। ইষ্টদর্শণই সব তীর্থদর্শণের সার। সন্ন্যাসী হয়েও তোমার পারলৌকিক কাজ আমি করবো। আজ রাতেই আমার বাহ্য সন্ন্যাসের আয়োজন কর।
অগত্যা দৈবের ইচ্ছা মেনে নিয়ে বিশিষ্টাদেবী চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সারারাত জেগে পুত্রের সন্ন্যাসের আয়োজন করলেন। পরদিন সকালে অন্যকোন সন্ন্যাসীআচার্য্য না থাকায় শঙ্কর নিজেই বিরজাহোম করে গৃহত্যাগ করলেন।
গুরুগৃহে অধ্যয়নকালে শঙ্কর শিক্ষাগুরুর মুখে শুনেছিলেন--অদ্বৈত তত্ত্বজ্ঞানী মহাযোগী গোবিন্দপাদ নর্মদাতীরে এক গুহায় সহস্র বৎসর যাবৎ সমাধিস্থ আছেন। বালক সন্ন্যাসী আত্মজ্ঞান লাভের ব্যাকুল আগ্রহে গুরুর সন্ধানে দুমাস পথ চলে নর্মদাতীরস্থ ওঁঙ্কারনাথ মঠে এসে উপস্থিত হন।
মঠের প্রাচীণ সন্ন্যাসীদের মুখে শুনলেন--নিকটবর্তী একটি গুহায় একজন যোগী শত শত বৎসর যাবৎ সমাধিমগ্ন হয়ে আছেন। যোগীটি সম্বন্ধে এরবেশী তাঁরা কিছু জানেন না।
প্রিয়দর্শণ বালযতিকে দেখে এবং তাঁর কথা শুনে আশ্রমবাসী সন্ন্যাসীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা শঙ্করের ইচ্ছানুসারে তাঁকে পথ দেখিয়ে একটা অন্ধকার গুহায় নিয়ে গেলেন। প্রদীপের আলোয় ধ্যানস্থ যোগীকে দেখেই এক অনির্বচনীয় আনন্দে শঙ্করের মন ভরে গেল। অশ্রুজলে প্লাবিত হলেন তিনি। উচ্চস্বরে স্বরচিত স্তব করতে লাগলেন। উপস্থিত সন্ন্যাসীরা সবিস্ময়ে দেখলেন--যোগীরাজের দেহে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছে। ধীরে ধীরে তিনি চোখ মেলে তাকালেন।
শঙ্কর মহাযোগীর চরণপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ে দীক্ষা এবং ব্রহ্মজ্ঞান দানের জন্য প্রার্থনা জানালেন।
গোবিন্দপাদ বালকসন্ন্যাসীকে দেখেই বুঝলেন--যাঁর প্রতীক্ষায় তিনি হাজার বছর ধরে সমাধিমগ্ন আছেন--ইনিই সেই শিবাবতার শঙ্কর। ইনিই ব্যাসদেবকৃত ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈতবিজ্ঞান জগতে প্রচার করবেন।
কথিত আছে ব্যাসদেব ব্রহ্মসূত্র রচনা করে স্বীয় পুত্র শুকদেবকে অদ্বৈতবেদান্ত শিক্ষা দেন। শুকদেব তাঁর শিষ্য গৌড়পাদকে ঐ তত্ত্ব শিক্ষা দেন। গুহায় সমাধিস্থ গোবিন্দপাদ তাঁর গুরু গৌড়পাদের নিকট ঐ তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন।
গোবিন্দপাদ গুরু পরম্পরায় ব্যাসদেবের নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে সহস্র বৎসর ধ্যানস্থঅবস্থায় শঙ্করের আগমন প্রতীক্ষায় ছিলেন--যিনি তাঁর কাছে অদ্বৈত ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে জগৎ কল্যাণের জন্য ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করবেন।
শঙ্করের আবির্ভাব প্রতীক্ষায় গোবিন্দপাদের সহস্র বৎসর ব্যাপী ধ্যানস্থ থাকার কাহিনীটির একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা এই ভাবে দেওয়া যায়--হাজার বছরব্যাপী বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে এবং চর্চার অভাবে বিস্মৃতপ্রায় বেদান্তধর্মের পুনর্জাগরণের মানসে আচার্য্য শঙ্কর একটা অভিনব আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে রূপ দেওয়ার জন্য সহস্র বৎসরের বিস্মৃতির অন্ধকার হতে ব্যাসদেবকৃত ব্রহ্মসূত্রটিকে উদ্ধার করে সেটির ভাষ্য রচনা করেছিলেন।
যাইহোক, শঙ্করাচার্য্য রচিত ব্যাসভাষ্য চরম সত্যের প্রকাশক সর্বোচ্চ একটা দার্শণিক ধারার জন্ম দিয়েছিল। তিনি তৎকালীন হিন্দুধর্মের আপাত বিরোধী বিভিন্ন ধর্মমতকে এক সার্বভৌম অধ্যাত্মবিজ্ঞানের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক কথায় বলা যায়--অধ্যাত্মভূমি ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম ধর্মসমন্বয়ের মহৎ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন।
গোবিন্দপাদ শঙ্করকে শিষ্যত্বে বরণ করে প্রথম বর্ষে হটযোগ এবং দ্বিতীয় বর্ষে রাজযোগ শিক্ষা দেন। এই দুটি যোগে সিদ্ধ হয়ে শঙ্কর নানা যোগবিভূতির অধিকারী হন।
তৃতীয় বর্ষে গোবিন্দপাদ শিষ্যকে জ্ঞানযোগ শিক্ষা দেন। জ্ঞানযোগ আয়ত্ব করে শঙ্কর অল্পদিনেই অপরোক্ষ ভ্রহ্মানুভূতির সর্বোচ্চ স্তরে প্রতিষ্ঠিত হন। মনের সর্বোচ্চ ভূমিতে স্বাভাবিক স্থিতির জন্য এখন হতে জীবকল্যাণের জন্য তাঁকে জোর করে মনকে জীবভূমিতে নামিয়ে আনতে হোত। তাঁর দেহে এই সময় হতে অপার্থিব ব্রহ্মজ্যোতির প্রকাশ দেখা যায়।
শিষ্য ব্রহ্মস্থিতি লাভ করেছে দেখে গুরু গোবিন্দপাদ শঙ্করকে সমগ্র ভারতব্যাপী বৈদিকধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়ে সমাধিযোগে দেহত্যাগ করেন। তিনি শঙ্করকে প্রথমে ভারতের অধ্যাত্মরাজধানী বারানসীধামে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন—পরবর্তী নির্দেশ তুমি সেখানেই পাবে।
আচার্য্য শঙ্কর বিন্ধারণ্য এবং প্রয়াগতীর্থ অতিক্রম করে বারানসীধামে এসে উপস্থিত হন। মনিকর্নিকার এক নির্জণ স্থানে তিনি অবস্থান করতে থাকেন। সেই সময় বারানসীধামে শৈব, পাশুপত, সাংখ্য, পতঞ্জল, সৌর, গাণপত্য, জৈন, বৌদ্ধ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের অনেক সাধক বাস করতেন।
অল্পদিনেই এই প্রিয়দর্শন জ্যোতির্ময় নবীন সন্ন্যাসীর অগাধ পান্ডিত্য এবং শাস্ত্রবিচারের অসাধারণ ক্ষমতার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শঙ্করের নিকট নানা মত ও পথের সাধক এবং পন্ডিতদের আনাগোনা শুরু হয়। শঙ্কর সকলের সব সংশয় দূর করে ধর্মের চরম লক্ষ্য অভেদসত্যের নির্দেশ দিতে থাকেন।
শঙ্করের উপস্থিতির প্রভাবে কাশীধামের নিষ্প্রভ আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল নূতন প্রাণশক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে।
এই সময়ের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা--চোলদেশীয় সনন্দন নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক তত্ত্বজ্ঞান লাভের আকাঙ্খায় কাশীধামে এসে উপস্থিত হন। লোকমুখে শঙ্করের যোগবিভূতি এবং অলোকসামান্য প্রতিভার কথা শুনে একদিন শঙ্করকে দেখতে আসেন। সনন্দনকে দেখেই শঙ্করের ভাল লেগে যায়। কিছুদিন শঙ্করের সঙ্গ করার পর সনন্দন দীক্ষা প্রার্থণা করেন। শঙ্কর সানন্দে সনন্দনকে শিষ্যত্বে বরণ করে নেন। সনন্দনই শঙ্করের প্রথম সন্ন্যাসীশিষ্য।
ইতিপুর্বে সনন্দন নৃসিংহদেবের উপাসনা করে বিভূতির অধিকারী হয়েছিলেন এবং বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে বিপন্ন হয়ে স্মরণ করা মাত্রই নৃসিংহদেব হাজির হয়ে সনন্দনকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সনন্দন ছায়ার মত গুরুকে অনুসরণ করতেন। গুরুসেবাই ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা। গুরুর প্রাণ রক্ষার জন্য বহুবার তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন। গুরুর দেহরক্ষার প্রয়োজনে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটতে অনেকবার দেখা গেছে। অসাধারণ প্রতিভা এবং অগাধ শাস্ত্রজ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি।
শঙ্করের কাশীধামে অবস্থানকালের বহুলপ্রচারিত দুটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা--যা দৈবইচ্ছায় সংগঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং যা শঙ্করের তত্ত্বজ্ঞান ও ব্যবহারিক আচরণের মধ্যে অসামঞ্জস্য দূরীকরণে সাহায্য করেছিল--তা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
শঙ্কর একদিন অতি প্রত্যুষে সশিষ্য স্নানের জন্য মনিকর্ণিকার সংকীর্ণ গলিপথে চলেছেন। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলেন--একজন যুবতী মৃ্তপতিকে কোলে নিয়ে সংকীর্ণ পথজুড়ে বসে আছে। মৃতপতির সৎকারের জন্য বিলাপ করে সাহায্য চাইছে।
রাস্তার একপাশে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্নানের দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে শঙ্কর স্ত্রীলোকটিকে বললেন—মা! শবটিকে তুমি ওপাশে সরিয়ে নাও, আমরা যাতে পাশ দিয়ে চলে যেতে পারি। শোকাতুরা স্ত্রীলোকটি প্রথমে শঙ্করের কথায় কান দিল না। শঙ্কর বার বার অনুরোধ করায় স্ত্রীলোকটি বললো--কেন যতিবর? আপনি শবকে সরে যেতে বলুন না!
বিস্মিত শঙ্কর একথা শুনে বললেন--শোকে কি তোমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? শব কি কখনও সরে যেতে পারে?
স্ত্রীলোকটি শঙ্করের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বললো--কেন পারবে না যতিবর! আপনার মতে তো শক্তিনিরপেক্ষ ব্রহ্মেরই জগৎকর্তৃত্ব। শব কেন পারবে না?
রমনীর কথায় শঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। হঠাৎ শবসহ স্ত্রীলোকটি অন্তর্হিত হোল। শঙ্কর বুঝলেন--শক্তিরূপিনী মহামায়া নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিয়ে গেলেন। তাঁর চিন্তায় এক আলোড়ন দেখা দিলো। আদ্যাশক্তি যেন কৃপাপরবশ হয়ে শঙ্করের ব্রহ্মউপলব্ধির মধ্যে তখন পর্য্যন্ত যে গন্ডী ছিল--তা অপসারিত করে দিয়ে গেলেন। ব্রহ্ম মির্গুণ, নিষ্ক্রিয়। শক্তিনিরপেক্ষ ব্রহ্মের দ্বারা সৃজন, পালন এবং সংহার কি ভাবে সম্ভব?
অঘটনঘটন পটিয়সী মহাশক্তি ব্রহ্মেরই গুণ। যেমন আগুন, আর তার দাহিকাশক্তি। স্বরূপতঃ আগুন নির্লিপ্ত। সে জানে না তার দাহিকাশক্তি যাকে পুড়িয়ে মারলো সে পাপী? না, নিষ্পাপ? আগুন দাহিকাশক্তির কর্তৃত্ব নিরপেক্ষ, কিন্তু দাহিকাশক্তি আগুন নিরপেক্ষ হতে পারে না। অচ্ছেদ্যতার কারণে দাহিকাশক্তিনিরপেক্ষ আগুনকে ভাবা কষ্টসাধ্য।
বলা হয়ে থাকে--গুণকে আশ্রয় করেই নির্গুণ ব্রহ্ম হন সগুণ ঈশ্বর। জ্ঞানীর দৃষ্টিতে যিনি অদ্বিতীয় একমাত্র সত্য নির্গুণব্রহ্ম, দ্বৈতভূমিতে ভক্তের দৃষ্টিতে তিনিই আবার সর্বশক্তিমান সগুণ ঈশ্বর।
শঙ্কর তাঁর ব্যাসভাষ্যে ব্রহ্মের সগুণ এবং নির্গুণ--এই দুই ধারণাকেই অবস্থা ভেদে সমর্থন করেছেন। অদ্বৈতবাদী শঙ্কর অধিকারী ভেদে কাউকে নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্ম, আবার কাউকে সগুণ সাকার ঈশ্বর উপাসনার বিধান দিয়েছেন।
আর একদিনের ঘটনা--অতি ভোরে সশিষ্য শঙ্কর স্নানের জন্য মনিকর্ণিকার ঘাটে এসেছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন--শৃঙ্খলাবদ্ধ চারটা কুকুর নিয়ে ভীষণমূর্তি এক চন্ডাল তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে। অনন্যোপায় শঙ্কর চন্ডালকে বললেন--তুই তোর কুকুরগুলো নিয়ে সরে দাঁড়া! আমাদের যেতে দে!
শঙ্করের কথায় অট্টহাস্য করে চন্ডাল বললো--তুমি কাকে সরে যেতে বলছ? আত্মাকে? না, দেহকে? আত্মা তো সর্বব্যাপী, নিরাকার। আর যদি দেহকে সরে যেতে বলে থাক--দেহ তো জড়। সে কেমন করে সরে যাবে?
শঙ্করকে নিরুত্তর দেখে চন্ডাল বললো--এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ বলে মিথ্যা অভিমান করছ। অদ্বৈতের দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণে আর চন্ডালে পার্থক্য থাকতে পারে? গঙ্গাজলে প্রতিবিম্বিত সূর্য্য, আর সুরার মধ্যে প্রতিবিম্বিত সূর্য্য কি পৃথক?
চন্ডালের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে শঙ্কর বিস্মিত এবং লজ্জিত হলেন। তিনি চন্ডালের উদ্দেশ্যে করজোড়ে স্তব করতে লাগলেন--যিনি সর্বভূতে সমজ্ঞান করেন এবং তদনুরূপ আচরণ করেন তিনিই আমার গুরু।
সহসা কুকুরসহ চন্ডাল অদৃশ্য হলেন। পরিবর্তে শঙ্কর দেখলেন জ্যোতির্ময় মূর্তিতে দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর সামনে দন্ডায়মান। শঙ্কর দেবাদিদেবকে প্রণিপাত করে স্তব করতে লাগলেন-- ‘পশুনাং পতিং পাপনাশং পরেশং গজেন্দ্রস্য কৃত্তিং বসানং বরেণ্যম্। ইত্যাদি।
মহেশ শঙ্করের মাথায় হাত দিয়ে বললেন--আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। বেদান্তের মুখ্য উদ্দেশ্য যে ব্রহ্মজ্ঞান তা প্রতিষ্ঠার জন্য তুমি ব্যাসদেবকৃত ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচণা কর। বেদান্তের নির্ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা ভ্রমসংকুল ধর্মীয় মতবাদ খণ্ডন করে বেদান্তধর্ম সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার কর। তোমার কাজ সমাপ্ত হলে তুমি আমাতেই মিলিত হবে। জগতের অশেষ কল্যান সাধনের জন্য তুমি আমার অংশে জন্মগ্রহণ করেছ।
ক্রমশঃ
0 Comments