মানুষের মনের মৃত্যু হয় কিভাবে,দুঃখের মধ্যেও আনন্দে থাকা সম্ভব কি

Devprayagদেবপ্রয়াগে ভাগীরথী, ছবি - সৌজন্যে - উইকিপিডিয়া

এবার বৃদ্ধ একবার ডাইনে বাঁয়ে চোখদুটোকে ঘুরিয়ে নিলেন। বুঝতে পারছি যাওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছেন। আমি সে সুযোগ না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মহাকবি কালিদাসের নাম শুনেছেন কিনা? উত্তরে মাথা নেড়ে জানালেন, ও নাম তিনি শোনেননি। আমি কালিদাসের গুণ ও সামান্য পরিচয় দিয়ে বললাম,

– বাবা, তিনি বলেছেন, মানুষের সমস্ত গুণের মৃত্যু হয় যদি তার দারিদ্র যোগ থাকে। আমার জিজ্ঞাসা, সুন্দর মনের মৃত্যু হয় কি যোগ থাকলে?



প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা খুব খুশি হলেন। কালিদাস নামক মহাকবির নাম না শোনার কারণ হিসাবে জানালেন তাঁর অক্ষর জ্ঞান নেই। লেখাপড়া করেননি তবে কালিদাস ‘যো বাত বোলা, উনহো নে সহি বাত বোলা’ বলে সাধুবাবা বললেন,বেটা, মানুষের মনের মৃত্যু কোথায় বাস করে জানিস? পরসমালোচনায় আর ক্রোধে। এই দুটো যদি ত্যাগ করতে পারিস তা হলে আর যাই হোক, দুঃখের মধ্যেও অনায়াসে থাকতে পারবি আনন্দে। মনের কথা যখন উঠল তখন আর একটা কথা জেনে রাখ বেটা, চন্দ্রের আলো স্নিগ্ধ বটে তবে শীতল নয়, শীতল নয় বরফও। শীতল হল ঈশ্বর বা গুরুপ্রেমে অনুরাগী মন।

একটু থেমে সাধুবাবা আবেগভরা কণ্ঠে বললেন,

– বেটা, দিন কেটে যাচ্ছে আহার আর অর্থচিন্তায়, রাত কেটে যাচ্ছে ঘুমে। আর সময় কোথায়? যত পারিস তাঁর নাম জপ কর। সংসারজালে মাছের মতো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে সবকিছু নিজের ভেবে। বেটা কখন যে কালরূপী বক এসে টুক করে তুলে নেবে তা কেউ একবারও ভাবছে না। বুড়ো বয়সে গিয়ে সাধনভজন করে তাঁর করুণা লাভ করব, এমন ভাবনাটা মাথাতেও রাখবি না। মনে রাখিস বেটা, যৌবন গেলে বিবাহ, বৃদ্ধ বয়েসে তীর্থ ভ্রমণ, রাতের শেষে স্ত্রী সহবাস এগুলি যেমন সময়ের কাজ অসময়ে করা, তেমনই বৃদ্ধ বয়েসে সাধন।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন। সাধুবাবার গুরুদেবের যোগৈশ্বর্যের কথা তো শুনেছি। এখন সোজা বলে বসলাম,বাবা, আপনার গুরুদেবের কথা তো শুনেছি। আপনি কিছু যোগবিভূতি দেখান যা চিরকাল মনে রাখার মতো।

কথাটা শুনেই হো হো করে হেসে ফেললেন। মন্দাকিনীর নির্মল ধারার মতো হাসির প্রস্রবণ। আমি এবার সাধুবাবার পা দুটো কোলের উপর টেনে নিয়ে টিপতে লাগলাম। হাত দিয়ে বাধা দিলেও শুনলাম না। ঠিক এই মুহুর্তে বৃদ্ধের গা থেকে ভুর ভুর করে জুঁইফুলের গন্ধ বেরতে লাগল। সাধুবাবা আমার চোখে চোখ রাখলেন, আমিও। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এল। বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বললেন,

– বেটা, আমার গুরুজি অসাধারণ যোগবিভূতিসম্পন্ন ছিলেন। ভাবনামাত্র অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, নিত্য প্রয়োজনের সমস্ত কিছু মুহুর্তে হাতে পাওয়া — যোগের যত রকম ক্ষমতা বা ঈশ্বর্য তা আমার গুরুজির মধ্যে ছিল। আমি বেটা গুরুজির মতো মুহুর্তে কিছু করে দেখানো, ভালো ভালো খাবার আনা, শূন্যে হাওয়া হয়ে যাওয়া, এ সব ‘চমৎকারী’ কিছু পারি না। তোর মতো সাধারণ। তাঁর নামে তাঁকে আশ্রয় করে পড়ে আছি, নিরোগ দেহে দিন রাত কেটে যায় আনন্দে।

বুঝে গেলাম সাধুবাবা যোগবিভূতির বিষয়টা এড়ানোর জন্য এসব কথা বললেন। আমি আর চাপাচাপি করলাম না। মনের বাসনা তিনি এরই মধ্যে মিটিয়ে দিয়েছেন পা টেপার সময় জুঁই-এর গন্ধ ছড়িয়ে। এবার বললাম,

– বাবা, এমন একটা উপদেশ দিন যা পালন করলে আমার কল্যাণ হয়।

কথাটা শুনে হাসিভরা মুখে বললেন,

– বেটা, তোরা ‘লিখাপড়া’ জানা ছেলে, তোদের কি উপদেশ দেব রে! তবে তুই যে কাজে আছিস তাতে মানুষ দেখলে বুঝে যাবি, এ ভরসাটা তোর উপর আছে। বেটা, জীবনে কখনও ধর্মের বিষয়ে ভোগী ও বিষয়ীদের ভগবদপ্রসঙ্গ অর্থাৎ ধর্মের কথা বা ধর্মীয় উপদেশ দিতে যাবি না। কেন জানিস, সুগন্ধি চন্দনবনে বাস করলেও যেমন সাপের স্বভাব বদলায় না, তেমনই ঘোর বিষয়ী বা ভোগী মানুষের সাধুসঙ্গেও ভোগ ও বিষয়চিন্তা দূর হয় না।


এবার সাধুবাবা তাঁর গুরুজির উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়ে পরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

– বেটা, এখন পা দুটো ছেড়ে দে। জীবনে এই প্রথম কেউ আমরা পা টিপে দিল। তোকে আশির্বাদ করার ক্ষমতা আমার নেই তবে গুরুজির কাছে প্রার্থনা করি, তোর সমস্ত দুঃখ দুর্দশা যেন দূর করে দেন। আগামী জীবনে দিনগুলো যেন কাটে ‘আনন্দ্ আনন্দ্ আনন্দ্ মে।’

সারা জীবনে মানুষ সাধনা করে যা লাভ করার জন্য, তা বিনা সাধনায়, বিনা চেষ্টায় পেলাম। সাধুবাক্যের মাধ্যমে। দুর্লভ আশির্বাদে স্নাত শিবশংকর কেঁদে ফেলল। ব্রজবিদেহী মহন্ত শ্রীশ্রী রামদাস কাঠিয়াবাবাজি মহারাজ বলেছেন, ‘সাধুসন্ত অউর গুরুকা বচন কভি ঝুট নেহি হোতা হ্যায়।’ এ কথায় আমার বিশ্বাসের সীমা পরিসীমা নেই। এ ছাড়াও জানা আছে, সাধুসন্ন্যাসী এবং গুরু এরা কখনও দৃষ্টির দ্বারা, কখনও স্পর্শের দ্বারা, কখনও বা বাক্যের দ্বারা ভক্ত বা সন্তানের (শিষ্য) কল্যাণ করেন থাকেন।

জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, দয়া করে বলবেন, কি করলে শরণাগত হওয়া যায়?

আমার প্রশ্নে একটা অদ্ভুত প্রসন্নতার ছাপ ফুটে উঠল সাধুবাবার মুখে। হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

– বেটা, শরণাগত হওয়ার কোনও পথ বা পদ্ধতি আমার জানা নেই। বৃক্ষ যেমন আপনা থেকে বড় হয়, এক সময় সুশোভিত হয়ে ওঠে ফলে ফুলে, কিন্তু কেমন করে তা হয়, তা যেমন কেউই বলতে পারে না, তেমনই মানুষের শরণাগত হওয়ার কোনও পথ বলা যায় না। আমি যেটুকু বুঝি, গুরুবাক্যে বিশ্বাস করে চলা, সৎ ও সাধুসঙ্গ, সদগ্রন্থ পাঠ ইত্যাদি ক্রমাগত করতে থাকলে বৃক্ষের ফল ফুলের মতো এক সময় আপনা থেকেই লাভ হয় শরণাগতি, বর্ষিত হয় ভগবানের করুণাধারা। কথা শেষ হতে প্রশ্ন এল মাথায়, করেই ফেললাম,

– বাবা, সংসারজীবনে যা কিছু, আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে বিষয় সম্পত্তি, সমস্ত কিছুর উপর থেকে মায়া কাটানো যায় কি ভাবে, দয়া করে এ বিষয়ে কিছু বলবেন!এ কথা শুনে সাধুবাবা একটু মুচকি হাসি হাসলেন। মুখেরদিকে তাকিয়ে বললেন,

– তোর চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছে উপাস্য দেবতা ‘কালীমাঈয়া’।

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই বললেন,

– বেটা, কোনও কিছু করেই মায়া কাটানো যায় না মা (গুরু) যদি মায়া না কাটায়। তবে একটা কথা মনে রাখিস, গুরুরও মায়া আছে। তাঁর মায়া দুরকম। পারমার্থিক মায়া আর জাগতিক মায়া। শিষ্যের উপর গুরুর যে মায়া তা পারমার্থিক। এ মায়া শিষ্যের মুক্তির পথ সুগম করে। এ মায়া না থাকলে শিষ্যের চলবে কেমন করে! শিষ্যের উপরে গুরুর আর একটা মায়া ক্রিয়া করে যা শিষ্যকে সংসারজীবনের নানান দুঃখ দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করে। এটা গুরুর জাগতিক মায়া।

– বাবা, আমার কিছু অভিযোগ আছে ভগবানের বিরুদ্ধে তবে তাঁকে তো আপনার মতো সামনে পাব না তাই আপনার কাছেই সে কথা জানাবো। কারণ সাধু সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণ ও গুরু, এদের কর্তব্য হল মানুষের কথা শোনা এবং কষ্টের উপশমের জন্য পথ বা উপায় বাতলে দেওয়া। আপনি যদি অনুমতি ও সময় দেন তো বলতে পারি।

এ কথা শুনে সাধুবাবা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিনিট খানেক। এখন চোখ দেখে মনে হল যেন এক্সরে মেশিন। পরে প্রসন্ন মুখমণ্ডলের মধ্যে ফুটে উঠল কেমন একটা অস্বস্তি আর অস্থিরতার ভাব। তবুও মুখে হাসির প্রলেপ মাখিয়ে বললেন,

– বল্ না বেটা বল্, পারলে উত্তর দেব, না পারলে দেব না, ‘ভাগ যায়গা’। মন খুলে বল্ তো তোর অভিযোগের কথা।

এবার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সঞ্চিত ক্ষোভ দুঃখ দুর্দশা সব সাধুবাবার চরণে ভগবান জ্ঞানে উগরে দিলাম এইভাবে,

– বাবা, সেই ছোটবেলা থেকে আমার দুঃখের যেন আর শেষ নেই। পরের বাড়িতে পাঁচবছর বয়েসে আশ্রয় নেওয়া, স্কুলমাস্টারের হাতে পায়ে ধরে স্কুল ফ্রি করে পড়াশোনা, বাল্যে বাবার মৃত্যু, ছোটবেলা থেকে প্রবল বাসনা ছিল সাধু হব, তা হল না। শিল্পী হব বলে ছবি আঁকা শিখলাম, হতে পারলাম না। মাটির মূর্তি গড়তে পারি, সেখানেও কিছু হল না। দীর্ঘদিন ধরে খুব ভালো ম্যাজিক শিখেছিলাম, যাদুকর হতে পারলাম না। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ‘না’ ছাড়া ‘হ্যাঁ’ কিছু হল না। সংসারে অভাবের শেষ নেই। ভাই বোনেদের ভালো খাবার জোটে না। নিজের কোনও আয় নেই। গর্ভধারিণী মায়ের কষ্টের কোনও অন্ত নেই। সারাটা জীবন মা আমার দুঃখ অভাব আর কষ্টই পেয়ে গেল। একমাত্র মা ছাড়া গরিব বলে কোনও নারীর ভালোবাসা জুটল না কপালে। আজ পর্যন্ত কখনও মিথ্যা ও অসত্যের আশ্রয় নিইনি। আপনি তো অন্তর্যামী। কোন জন্মের কি অপরাধে জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত দুঃখ ছাড়া আর কিছুই জুটল না কপালে, কেন? এর উত্তর আমাকে না দিলে আমি কিছুতেই ছাড়ব না আপনাকে।মনের আরও কথা, আরও ক্ষোভ দুঃখ বেদনার কথা যা অন্তরে এতদিন সযত্নে রাখা ছিল তা সবই জানালাম অকপটে। এখানেই থেমে রইলাম না। বললাম,

– বাবা, আপনি হয়তো বলবেন, পূর্বজন্মের কোনও কর্মফলের জন্য আমার এই কষ্ট। তাহলে আপনাকে একটা গল্প বলি শুনুন।

শীতকাল, একদিন দুই মাতাল দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে মদ আর মাংস খাচ্ছে মহানন্দে। এমন সময় দুজন বৈষ্ণব কনকনে শীতের মধ্যে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে গঙ্গাস্নানে। তারা মাতাল দুজনকে দেখে একজন আর এক জনকে বলছে,

– জানিস, এ দুটো মাতালের জীবনটা একেবারে বরবাদ হয়ে গেল। সকালে উঠে ভগবানের নাম করার বালাই নেই। বসে শুধু মদ মাংস গিলছে। এ জন্ম তো গেলই, মৃত্যুর পরও কষ্টের শেষ থাকবে না উপরে গেলে। নরকেও ঠাঁই হবে না। পরজন্মে বিষ্ঠার কীট হয়ে জন্মাবে।

কথা কটা কানে এল মাতালদের। তারা ডেকে দাঁড় করালেন বৈষ্ণব দুজনকে। সানন্দে হাসতে হাসতে বললেন,

– বৈষ্ণব ঠাকুর, এই হাড় কাঁপানো শীতে ঠকঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছ গঙ্গাস্নান করতে। ফিরে গিয়ে সাধনভজন করবে মৃত্যুর পর পরজন্মে বা পরলোকে সুখের আশায়, তাই তো! তা ভালো, তবে আমরা এজন্মে মদ মাংস ইত্যাদি খেয়ে আনন্দ আর মস্তি করি। পরজন্মে কষ্ট পাব। এজন্মে তোমার কষ্ট, পরজন্মে সুখ। এ জন্মে আমার সুখ, পরজন্মে কষ্ট। তাহলে ব্যাপারটা তো একই হল না। এবার বল তো ঠাকুর, পরজন্ম আছে কি নেই তা তুমিও জানো না, আমিও না, এবার কি বলবে?

একটানা বলে একটু থামলাম। কোনও দিকেই চোখ আর মনটা নেই। সাধুবাবাকে বললাম,

– বাবা, এবার আপনার বক্তব্য জানান, আমার কোন জন্মের কি অপরাধে একটু ভালো খাওয়া জোটে না? এ কষ্ট তো আর সহ্য করা যায় না। কিছু বলুন বাবা!

এতক্ষণ কথা বলছিলাম পায়ের দিকে তাকিয়ে। এখন মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম নব্বই বছরের বৃদ্ধের দুচোখ থেকে কপোল বেয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথীগঙ্গা আর অলকানন্দা ধারা। এবার পা দুটো ধরে বললাম,


– বাবা, আমার প্রশ্নের জবাব না দেয়া পর্যন্ত কিছুতেই পা ছাড়ব না।

সাধুবাবা সমানে দুটো হাত মাথায় বোলাতে লাগলেন, মুখে প্রশ্নের কোনও উত্তর দিচ্ছেন না দেখে এবার মাথাটা আমার সাধুবাবার পায়ে কাঁদতে কাঁদতে সমানে খুটতে লাগলাম। হঠাৎ পাথরে কপালটা আঘাত পেতেই চমকে মাথাটা তুললাম। দেখলাম, সাধুবাবা নেই। ছোট্ট ঝোলাটাও নেই।

Post a Comment

0 Comments